শরীরে ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধিকারী জিনের পরিবর্তন থাকলেও তা জানতেন না এক শুক্রাণুদাতা। জিনগত এই পরিবর্তনের বিষয়ে না জেনেই শুক্রানু দান করে অন্তত ১৯৭ শিশুর জন্ম দিয়েছেন তিনি। ইউরোপীয় ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিসহ ১৪টি গণমাধ্যম এই বিষয়ে যৌথ অনুসন্ধান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ওই দাতার শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া কিছু শিশু মারা গেছে বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে। যারা তার পরিবর্তিত জিন পেয়েছে, তাদের মধ্যে একেবারে সামান্য সংখ্যক শিশু সারাজীবন ক্যানসার এড়াতে পারবে।
যদিও যুক্তরাজ্যের কোনও ক্লিনিক ওই দাতার শুক্রাণু কেনেনি। তবে বিবিসি নিশ্চিত করে বলেছে, ডেনমার্কে চিকিৎসা নেওয়া হাতে গোনা অল্পসংখ্যক ব্রিটিশ নারী ওই দাতার শুক্রাণু ব্যবহার করেছিলেন। তাদের ইতোমধ্যে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডেনমার্কের ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারের প্রতি তাদের গভীর সহানুভূতি রয়েছে। কিছু দেশে ওই দাতার শুক্রাণু অতিরিক্ত সংখ্যক সন্তানের জন্মে ব্যবহৃত হয়েছে বলেও তারা স্বীকার করেছে।
২০০৫ সালে ছাত্রাবস্থায় পারিশ্রমিক নিয়ে বেনামে শুক্রাণু দান শুরু করেন ওই ব্যক্তি। প্রায় ১৭ বছর ধরে নারীরা তার শুক্রাণু ব্যবহার করেছেন। তিনি সুস্থ ছিলেন এবং স্ক্রিনিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হন। তবে জন্মের আগেই তার শরীরের কিছু কোষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় টিপি৫৩ নামের জিন; যা শরীরকে ক্যানসার থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দাতার শরীরের বেশিরভাগ কোষে ওই বদল পাওয়া যায়নি। তবে তার শুক্রাণুর প্রায় ২০ শতাংশে বিপজ্জনক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আক্রান্ত শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের শরীরের প্রতিটি কোষেই এই ত্রুটি দেখা যায়।
এই জিনগত অবস্থাকে বলা হয় ‘লি-ফ্রাউমেনি সিনড্রোম’। এতে ক্যানসারের ঝুঁকি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত; বিশেষ করে শৈশব ও যুব বয়সে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার এবং পরবর্তী জীবনে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চের ক্যানসার জিনতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক ক্লেয়ার টার্নবুল বলেছেন, এটি একটি ভয়াবহ রোগ নির্ণয়। এটি পুরো পরিবারকে আজীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়; যা অত্যন্ত বিধ্বংসী।
এ অবস্থায় শরীর ও মস্তিষ্কের এমআরআই স্ক্যানের পাশাপাশি পেটের আলট্রাসাউন্ড প্রতি বছর করাতে হয়। অনেক নারী ঝুঁকি কমাতে স্তন অপসারণের পথ বেছে নেন। ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক বলেছে, দাতা ও তার পরিবার অসুস্থ নন এবং এ ধরনের মিউটেশন আগে থেকে স্ক্রিনিংয়ে ধরা যায় না। সমস্যা ধরা পড়ার পর দাতার নমুনা সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্লক’ করা হয়।
চলতি বছর ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান জেনেটিকসের চিকিৎসকরা বিষয়টি সামনে আনেন। তারা বলেছেন, পরিচয় শনাক্ত হওয়া ৬৭ শিশুর মধ্যে ২৩ জনের শরীরে জিনের পরিবর্তন ঘটেছে। তাদের মধ্যে ১০ জন ইতোমধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই দাতার স্পার্মে জন্মগ্রহণ করা শিশুর সংখ্যা অন্তত ১৯৭। তবে সব দেশের তথ্য না পাওয়ায় চূড়ান্ত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও কতজন শিশু মারাত্মক জিনগত পরিবর্তন পেয়েছে, সেটি এখনও জানা যায়নি।
ফ্রান্সের রুয়াঁ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ড. এদুইগ ক্যাসপার বলেন, অনেক শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। কেউ কেউ দুই ধরনের ক্যানসারেও ভুগেছে। খুব অল্প বয়সেই কয়েকজন মারা গেছে।
ফ্রান্সের সেলিন (ছদ্মনাম) নামের এক নারী ১৪ বছর আগে ওই দাতার শুক্রাণু দিয়ে সন্তানের জন্ম দেন। তিনি বলেন, তার মেয়ের শরীরে ওই জিন পাওয়া গেছে। বেলজিয়ামের ক্লিনিক তাকে ফোন করে দ্রুত পরীক্ষা করাতে বলেছে।
দাতার প্রতি কোনও ক্ষোভ নেই জানালেও তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ, নিরাপদ নয়; এমন শুক্রাণু আমাকে দেওয়া অগ্রহণযোগ্য। সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত। সেলিন বলেন, আমরা জানি না কোন ক্যানসার, কখন হবে, কতবার হবে। সম্ভাবনা খুবই বেশি। হলে লড়াই করব; একাধিকবার হলেও।
ওই এক দাতার শুক্রাণু ১৪ দেশের ৬৭টি ক্লিনিকে ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে বিক্রি না হলেও ডেনমার্কে চিকিৎসা নিতে যাওয়া কিছু ব্রিটিশ নারী ওই দাতার শুক্রাণু কিনেছেন। যুক্তরাজ্যের ফার্টিলিটি কর্তৃপক্ষ (এইচএফইএ) বলেছে, ব্রিটিশ নারীদের ওই দাতার শুক্রাণু পাওয়ার সংখ্যা অত্যন্ত কম। তবে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দাতার শুক্রাণু কতবার ব্যবহার করা যাবে; এ বিষয়ে বিশ্বের কোনও দেশেই সুনির্দিষ্ট কোনও আইন নেই। যদিও প্রত্যেক দেশে দাতার শুক্রাণু দানের বিষয়ে নিজস্ব সীমারেখা থাকে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেলজিয়ামসহ বেশ কয়েকটি দেশে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বেলজিয়ামে একজন দাতার শুক্রাণু সর্বোচ্চ ছয় পরিবার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ওই দাতার মাধ্যমে ৩৮ নারী ৫৩ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আর যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রের একজন দাতার শুক্রাণুর সীমা সর্বোচ্চ ১০ পরিবার।
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালান পেসি বলেন, আন্তর্জাতিক স্পার্ম ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় একই দাতার শুক্রাণু বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হচ্ছে।আর এখানেই ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এটি সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই ভয়াবহ। কিন্তু সব রোগ পরীক্ষা করা অসম্ভব। অত্যন্ত কঠোর স্ক্রিনিং করলে হয়তো দাতা পাওয়া যাবে না।
এই ঘটনা এবং আগের এক দাতার ৫৫০ সন্তানের জন্ম দেওয়ার ঘটনায় আবারও কঠোর সীমা নির্ধারণের দাবি উঠেছে। ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান রিপ্রোডাকশন অ্যান্ড এমব্রিয়োলজি সম্প্রতি প্রতি দাতায় ৫০ পরিবারের সীমা প্রস্তাব করেছে।
তবে সংগঠনটি বলছে, এতে বিরল জিনগত রোগের ঝুঁকি কমবে না; বরং অসংখ্য শিশুদের মানসিক ভালো থাকার প্রশ্নই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দাতার শুক্রাণু ব্যবহার করে জন্ম নেওয়া মোট শিশুর তুলনায় এই ঘটনা অত্যন্ত বিরল। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্লিনিকে শুক্রাণু ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক স্ক্রিনিং করা হয়; যা সাধারণ পিতৃত্বের ক্ষেত্রেও হয় না।
অধ্যাপক পেসি বলেন, আমি জানতে চাইতাম, তিনি স্থানীয় (যুক্তরাজ্যের) দাতা কি না। যদি বিদেশি দাতা হন, তাহলে প্রশ্ন করা যুক্তিসঙ্গত, আগে কতবার ব্যবহার হয়েছে বা ভবিষ্যতে কতবার ব্যবহার করা হবে।
সূত্র: বিবিসি
এবি